বিবরণ |
সত্যটা মিথ্যা: শেষরাতের দিকে বৃষ্টি কমে এসেছে। রেজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন। সীমান্তবর্তী ছােট্ট এই শহরের নাম বনগিরি। এর বেশিরভাগই পাহাড় আর জঙ্গল। দিন পনেরাে হলাে তিনি এখানে এসেছেন। এখনাে শহরের গতিপ্রকৃতি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন, এখানে চারদিকে অবিরাম ফিসফাস। লুকোচুরি খেলা। সেই খেলায় তিনি পুলিশ হলেও বাকিরা সবাই চোর নয়। ফলে ঠগ বাছতে গাঁ। উজাড় করতে চান না তিনি। রেজা শেষ মুহূর্তে পিস্তলটা বের করলেন। সাবধানে দেয়াল ঘেঁসে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন দরজার কাছে। হরিণের মতো উৎকর্ণ হয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা চারপাশ জুড়ে। যেন কোনো অশনি সঙ্কেত ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। আর সেই অশনি সঙ্কেতটাকেই ধরার চেষ্টা করছেন তিনি। আচমকা পর্দাটা সরিয়ে বিদ্যুৎ বেগে ঘরে ঢুকে পড়লেন রেজা। তারপর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একপাশে নিচু হয়ে দাঁড়ালেন। শরিফুল সঙ্গে সঙ্গেই আলো ফেলল খোলা দরজায়। সেই আলোতে চোখ রেখে অকস্মাৎ থমকে গেলেন রেজা। তার গা হিম হয়ে এলো আতঙ্কে! এখানে এই দৃশ্য দেখার কথা কল্পনায়ও ভাবেননি তিনি। রোগী দেখার উঁচু বেডে সাদা বিছানার চাদর। সেই চাদর ভিজে জবজব করছে টকটকে লাল রক্তে। যেন এই কিছুক্ষণ আগেই কাউকে চেপে ধরে জবাই করা হয়েছে এই বিছানায়। ছদ্মবেশ: ভূমিকা মানুষ রহস্যময়তা পছন্দ করে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে সেটা বুঝতে পারে না। জীবনভর সে তার প্রিয়তম মানুষটিকেও পুরােপুরি বুঝে ফেলতে চায়, কিন্তু পুরােপুরি বােঝা হয়ে গেলে তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সে আসলে অবচেতনে সবসময়ই অনুদঘাটিত কিছু রহস্য উদঘাটন করতে চায়। যতক্ষণ অবধি সেই রহস্য থাকে, ততক্ষণ অবধি একটা প্রবল আগ্রহ, আকর্ষণ কাজ করে । রহস্য শেষ হয়ে গেলে আকর্ষণ ফুরিয়ে যায়। অথচ জীবনজুড়েই সে ভাবে, সে রহস্য পছন্দ করে না। মানুষের ভেতরে এই দ্বান্দ্বিক সত্ত্বাটা আছে। মানুষ ভাবে, সে ভয় পেতেও পছন্দ করে না, নৃশংসতা পছন্দ করে না। কথা সত্য না। সে অতি আগ্রহ নিয়ে গা হিম হয়ে আসা হরর সিনেমা দেখে, ভূতের বই পড়ে, সিরিয়াল কিলারের ভায়ােলেন্ট মুভি দেখে, সাহিত্য পড়ে। এ কারণেই শিল্প-সাহিত্যে বৈচিত্র্যময় নানান ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে। রহস্যোপন্যাস সাহিত্যের সেরকমই একটি সমৃদ্ধ শাখা। এই শাখাটির প্রতি আমার আগ্রহ একদম শৈশবেই। তবে তা শুধুই পড়ার জন্য, লেখার জন্য নয়। কারণ, এই ঘরানাটিকে আমার খুবই কঠিন এবং একই সাথে গাণিতিক ক্যালকুলেটিভ’ মনে হয়। ফলে এতােদিনে কখনােই রহস্যোপন্যাস লেখার কথা আমি ভাবিনি। তাহলে এই উপন্যাসটি কেন লিখেছি? এই উপন্যাস লেখার কারণটা মজার। বহুবছর আগে এক দৈনিক পত্রিকায় হঠাৎ করেই একটি খুনের ঘটনা পড়েছিলাম। ঘটনাটি খুবই সাধারণ। পুলিশ লাশসহ খুনিকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু তারপরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। সেই রহস্যের কোনাে কুল কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বিষয়টা আমার মাথায় গেঁথে গেলাে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। অবচেতনেই ঘুরেফিরে বারবার মাথায় চলে আসতে লাগলাে সেই ঘটনা। এই করতে করতেই আচমকা একদিন একটা গল্পও চলে এলাে মাথায়। সেই গল্প লিখেও ফেললাম। লিখতে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, গল্পের প্রধান চরিত্রটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছি। এই চরিত্রটি নিয়ে আমি ধারাবাহিকভাবে আরাে লিখতে চাই। প্রতিটি বইতে সে একেকটি রহস্যের সমাধান করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রহস্য গল্প লেখা কঠিন। এই কঠিন কাজটি আমি নিয়মিত করতে পারবাে কিনা, সেটি নিয়ে খানিক সংশয়ও আছে। সেই সংশয় নিয়েই আমার প্রথম রহস্যোপন্যাস ছদ্মবেশ। ‘ছদ্মবেশ’ শেষ অবধি রহস্যোপন্যাস হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত পাঠকের। শেষ অধ্যায় নেই: একটি ধারাবাহিক চরিত্র নির্মাণের ইচ্ছে থেকেই মূলত রেজা সিরিজের শুরু। তবে সেই শুরুটা ছিল দারুণ সংশয়পূর্ণ। এর মূল কারণ আমার অভ্যস্ত পরিসর বা ‘কম্ফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে এসে রহস্যোপন্যাস লেখার চেষ্টা। যাকে আমি বরাবরই দুঃসাহসী চেষ্টা বলে স্বীকার করেছি। ফলে এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ছদ্মবেশ’ লিখেছিলাম একদমই পরীক্ষামূলক হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই পরীক্ষায় পাঠক সম্ভবত আমাকে পাস মার্কস দিয়ে দিয়েছেন। কারণ প্রথম উপন্যাসের পর দিন যত গড়িয়েছে, ততই এর পরবর্তী উপন্যাসের দাবি উচ্চকিত হয়েছে। বিষয়টি একই সঙ্গে আনন্দ ও শঙ্কার। কারণ প্রথম বইটি নিয়ে কারােই কোনাে প্রত্যাশা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় বইটি নিয়ে তা তৈরি হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এই প্রত্যাশা পূরণের ভাবনা নিয়ে আমি লিখতে পারি না। কারণ লেখক হিসেবে আমি স্বতঃস্ফূর্ত। আমার ইচ্ছের অধীন। সেই ইচ্ছে শেষ অবধি আমাকে দিয়ে শুধু আমার গল্পটিই লিখিয়ে নেয়। সেই গল্প কখনাে কখনাে অন্য সবার গল্পও হয়ে ওঠে, কখনাে কখনাে হয় না। শেষ অধ্যায় নেই আমার তেমনই একটি গল্প। তবে লেখক হিসেবে লােভ হয়, আমার এই গল্পটিও অন্য সবার গল্প হয়ে উঠবে। - সাদাত হােসাইন |